আমাদের সমাজব্যবস্হা বা মডার্ন নেক্রপলিস

'Decay of Society' by Michael DeBonis
আমাদের দেশের সমাজব্যবস্হা খুবই অদ্ভুত ধরনের। জানি এটি নতুন কোনো কথা না তারপরও বললাম। সবচেয়ে অবাক লাগে এটা ভেবে যে এখানে মানুষ নিজেদের বর্তমান পরিস্থিতিতেই খুশি থাকে বেশি। বিশেষকরে এদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি। আমার তো মনে হয় এদেশের বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত এটাই জানে না যে তারা মধ্যবিত্ত। এই শ্রেণি খুবই জটিল ভাবে সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স আর ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স এর মাঝামাঝি অবস্থান করছে। তারা সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণিকে ভয়ানক ভাবে অনুকরণ করে ঠিকই, তবে ওদের মতো হওয়ার যে খিদে,আকাঙ্ক্ষা বা স্বপ্ন, এসব মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে ভীত করে তোলে। আর নিজেদের চেয়ে নিচু অবস্থান এ যারা রয়েছে অর্থাৎ নিম্নবিত্ত শ্রেণির সাথে এরা অদ্ভুত ভাবে আচরন করে। তাদের জন্য পূর্নসমবেদনার তো কোন অভাব নেই( এদেশের বর্তমান বেশিরভাগ মধ্যবিত্তই কিন্তু এই নিম্নবিত্ত শ্রেণি থেকেই প্রমোশন পাওয়া, নিজেদের অতীতের কথা চিন্তা করেই হয়তো নিম্নবিত্তদের প্রতি সমবেদনা একটু বেশিই) আবার তাদের সামনে নিজেদের 'বড়লোক' দের কাছ থেকে অনুকরণ করা জীবন যাপন 'শো অফ' করতে বড়ই ভালোবাসে। নিজেদের কম্পফোর্ট জোনের যে বাবলে মধ্যবিত্তরা আটকা পড়ে রয়েছে, এটাকে তারা বড়ই পছন্দ করে।এটাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এমন সব কাজকেই ঘৃনা করে এরা। এটি অবশ্য সব শ্রেণির জন্যই প্রযোজ্য। এদেশের সমাজব্যাবস্হাটা এরকম অনেক গুলো বাবলের সমন্বয় এ তৈরি। কোন এক জামানার অলিখিত নিয়মে এই বাবল গুলোকে ফুটো হওয়া থেকে বাঁচাতেই সবার ভয়ংকর প্রচেষ্টা৷ কেউ যদি এই চিরচায়িত নিয়মের বিরুদ্ধে যেয়ে কিছু করার চেষ্টা করে তাহলে তো পুরো সমাজ ওর পিছনেই লেগে পড়ে। কিছুদিন আগে একটা পত্রিকায় পড়লাম যে, একজন মেয়ে আমেরিকা পড়তে যেয়ে ওয়েস্টার্ন ঘরনার খোলামেলা পোশাক পরা শুরু করেছে এবং এই অপরাধে তার পুরো পরিবারকে একঘরে করে দেয় পুরো সমাজ। এটি হাস্যকর তো বটেই সেই সাথে প্রচুড় কষ্টদায়ক ও। এটাই তো হওয়ার ছিল, এই দেশের সব সমাজের কাছে তো এটাই অনুমিত ছিল। এক অদ্ভুত দায়িত্ব কাধে নিয়ে চলে এদেশের মানুষ।  তারা মনে করে আশেপাশে যাই হচ্ছে, তা যদি এই সমাজের প্রতিষ্ঠিত নিয়মের বিরুদ্ধে যায় তাহলে প্রতিটি নাগরিক এর দায়িত্ব হওয়া উচিত সেই 'ঘৃনিত' কাজ এর বিরোধিতা করা। ধর্মীয় গোড়ামির জন্যই বলেন বা সামাজিক নিয়মের অদৃশ্য শীকলে বন্ধির জন্য, এদেশের বেশিরভাগ মানুষের কাছে তাদের মোরালটাই তাদের সব। এবং এটিই বিশ্বের সেরা। এক গায়েবি আওয়াজ তাদের উপর এই গুরু দায়িত্ব দিয়ে যায় এটিকে রক্ষা করার। সারাটা জীবন এদেশের বেশির ভাগ মানুষ নিজেদের বাবলে থেকে এই সবকিছুকে একসঙ্গে,সঠিক ভাবে রাখতে রাখতে পুরো জীবন পার করে দেয়। মৃত্যুর সময়ও হয়তো এই আত্নসন্তুষ্টি নিয়ে মারা যায় যে, মৃত্যু পরবর্তী জীবনে এটির পুরষ্কার তো নিশ্চয় পাওয়া যাবে। কি হলো আর যে সে দেখলো না আর্কটিক অঞ্চলগুলোর উপর দিয়ে রাতে বয়ে যাওয়া 'অরোরা বরিয়ালিস' বা 'নর্দান লাইট'? পরকাল এ সুখ পাওয়া যাবে এটিই যথেষ্ট নয় কি? ওয়েস্টার্ন কালচার কে গালি দিয়ে,বয়কট করে 'সোয়াবের' আশা করা এই বাঙালিই কিন্তু সূযোগ পেলে সবার আগেই ডিবি ভিসার জন্য অবেদন করতে বিন্দু মাত্র দ্বিধা করবে না। বয়কট ফ্রান্সের নাড়া লাগনো এদের যদি বলা হয় কাল থেকে ফ্রান্স এ ফ্রি ভিসায় যাওয়া যাবে, তাহলে তারাও বিমানের চাকা ধরে যাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা লাগাবে। সমালোচনা করতে বড্ড ভালোবাসে এই জাতি। ভালো কাজ-খারাপ কাজ হিসেবে না, সমালোচনা টা সার্বজনীন,সবার জন্য। আর নিজেদের জ্ঞান এর গভীরতা নিয়ে এদের বড়ই অহংকার। জিপিএ-৫ দিয়ে যে জ্ঞান মাপার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, এর মধ্যে কেউ যদি ভুলেও জিপিএ-৪.৯৯  পাই, তাহলে তার তো আর মুখ দেখানোরও যোগ্যতা নেই! পুরো পরিবার এর জন্যই এটি বড্ড অসম্মান এর। তার জ্ঞান এর গভীরতা যে একদম শূন্য তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। নিজেদের জ্ঞান কে এরা বাস্তুতন্ত্রিক সম্পদের মতই মনে করে। এটার থেকে কে কিরকম আউটপুট পাবে ওটার উপর ভিত্তি করে নির্ধারন করা হয় কে কতো সফল। এদেশে একজন সরকারি আমলার সম্মান একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এর থেকেও অনেক বেশি। এর কারণ? শুধুমাত্র সে তার এই মুখস্ত করা জ্ঞানের বস্তা নিয়ে দুইটাই পরীক্ষায় পাস হয়েছে,এটাই? আমি তাদের পরিশ্রমকে কোন ভাবেই ছোট করার চেষ্টা করছি না। তাদেরই বা দোষ কি? আমাদের সমাজ তো এটাকেই পুরস্কৃত করছে এবং করবে। কি দরকার চারবছর পদার্থ বিজ্ঞান এ স্নাতক করে পরবর্তীতে স্ট্রিংক থিউরি নিয়ে রিসার্চ করার? বিসিএস ক্যাডার তো আর হওয়া যাবে না! আমাদের এই ধরনের চিন্তা ভাবনার কবে  পরিবর্তন আসবে অথবা আদৌ আসবে কিনা জানা নাই। নতুনদিনের ছেলেমেয়েদের বা আমাদের জেনারেশন থেকেও যে বড় আশা রয়েছে তাও বলছি না। জিনিস যেটি যেরকম ওটিকে ঠিক ওরকমই রাখার যে বৃত্ত আঁকা শুরু হয়েছে সেই বৃত্তে এই জেনারেশন ও আটকা পড়বে সেই ভয়েই দিন কাটাই। সাইফাই সিনেমাতে যেমন দেখানো হয়, জম্বির কামড়ে সুস্থ মানুষ ও জম্বিতে পরিণত হয় ঠিক  ওরকমই পরিস্থিতি আমাদের বর্তমান সমাজের।  জম্বিতে ভর্তি এই সমাজ। চারপাশে হাজার হাজার জম্বির মধ্যে একজন সুস্থ মানুষ থাকলে সেও তাদের কামড়ে জম্বিতে পরিণত হচ্ছে। এতে ওই মানুষকে দোষ দিয়েও পাড়া যাবে না। ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত থেকে কিভাবে এখানে নতুন করে ফুল ফোটা শুরু হবে ওটি দেখার আশাই করতে পারি সর্বোচ্চ। রিকি জারবিস এর 'After Life' সিরিজের একটি লাইন মনে পড়ছে খুবই, "You can't change the world,but you can change yourself"। আত্মশুদ্ধির মাধ্যমেই না হয় সমাজের শুদ্ধতা আসুক। ততদিন পর্যন্ত অপেক্ষাই করি বরং। 

Comments

  1. Nomoshkar Niben.
    Oprar Bangla Thekea apnar jnneh roilo onek bhalobasha. Apnar proti bakko choyon oshadaron laglo.
    Ebhabea likhea Jan.
    Bhogoban apnr mongol koruk
    Ahirbad roilo

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

The Crow Society

My submission for The Queen's Commonwealth Essay Competition 2021